জবেদা কান্নাভরা চোখে বললেন, ওরা আমরা মেয়েটাকে রাতের আঁধারে হত্যা করে, পাটের জমিতে ফেলে রেখেছিল। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর আজ বিকেল বেলায় ওর লাশ পেয়েছি। আমার একটি সন্তান একাত্তুরে শহীদ হয়েছে। আমি বিস্ময় চোখে তার দিকে তাকালাম। তার শক্তিহীন দুর্বল শরীর। বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু চোখে খুব ভালো দেখে। আমি বললাম, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি। জবেদা বললেন একাত্তুরে সন্তানের লাশ পাইনি। এখনো মনের ভেতর বেদনা স্মৃতি জেগে ওঠে। সবে মাত্র মেয়েটাকে ওরা হত্যা করেছে তার লাশ পেয়েছি কিন্তু এখনো মামলা হয় নি। সন্ত্রাসীরা আমাকে মামলা না করার জন্য বলেছে। মামলা করলে ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমার মেয়ের একটি ছেলে একটি মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। কিভাবে ওরা মানুষ হবে আর কিভাবেই বা আমি এই হত্যার বিচার চাইবো। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি একটি মানববন্ধন করতে চাই। আমরা সম্মিলিতভাবে এই হত্যার বিচার চাইবো। আপনি একজন জন প্রতিনিধি। আপনি সাথে থাকলে আমি সাহস পাবো। আমি বললাম আপনি আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ আমি অবশ্যই এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করবো। ভদ্র মহিলার মুখে একটু হাসি এলো। আসলে হাসির ভেতর এক গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে। মেয়েটির দুই সন্তান হওয়ার পরপরই জামাই ব্যবসার উদ্দেশ্যে সেই যে বাড়ি ছেড়েছে আর কোন দিন ফিরে আসেনি। বেঁচে আছে কি মরে গেছে কিছু জানিনা। ভদ্র মহিলা বললেন, এই পাশের গ্রামেরই আমার বাড়ি। বাড়ির সামনে একটি পুকুর আছে। পুকুরের পাশ দিয়েই ট্রেন লাইন। ছোট বেলায় ট্রেন গাড়ীর হুইসিল শুনে থমকে দাঁড়াতাম। সে এক মধুর স্মৃতি উদ্ভাসিত জীবনের নির্জন অবলম্বন। চন্দ্রের আলো দিয়ে ঢাকা রাত্রির গ্রাম জেগে উঠতো। জাগতিক প্রভাব মুক্ত জ্ঞানের আত্মবিভোরে। ট্রেন গাড়ী ঝক ঝক শব্দে ছুটে যেতে দ্রুত গতিতে, আমার দৃষ্টি বহুদূর তাকিয়ে থাকতো। আমি বললাম একাত্তুরে আপনার সন্তানকে যারা হত্যা করেছিল তাদের বিচার আরম্ভ হয়েছে। দেরীতে হলেও আপনার মেয়ে হত্যার বিচার হবে। আপনি একটা মানববন্ধন করুন ন্যায় বিচারের জন্য গ্রামের মানুষের গণস্বাক্ষর নিন। ভদ্র মহিলা কথাগুলো শুনে নিজ বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে সন্ত্রাসীরা তাকে ফলোআপ করছে। তিনি কোথায় কি কাজে কার কার সাথে যোগাযোগ করেন। সন্ত্রাসীরা পরিকল্পনা বৃদ্ধ মহিলাকে শেষ করতে পারলে সব শেষ হয়ে যাবে। তার শহীদ সন্তানেরাও বিচার হবে না, আর মেয়ে হত্যার বিচার তো দূরের কথা। ভদ্র মহিলা বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের ভেতর নক্ষত্র থেকে অনুভূতির উজ্জ্বল শুভ্রতা তাকে পৃথিবী থেকে ছেড়ে যাওয়ার গান শুনাচ্ছে। তৃষ্ণায় কাতর মন বিচারের দাবীতে প্রার্থনা করছে। কেউ শোনেনা তার কথা। গানহীন বালুচরের বুকে শুকনো শিশির ঝরে পড়ছে। নীরব স্থির নদী একা একা কাঁদছে। হঠাৎ আযানের শব্দে ভদ্র মহিলার ঘুম ভেঙে গেলো। ভদ্র মহিলা নামাজ সেরে সকালের নাস্তা করে গ্রামের মানুষের কাছে মানববন্ধনের জন্য যোগাযোগ করতে গেলো। গ্রামের মানুষ মানববন্ধনে তেমন সারা দিল না। সবাই বিষয়টা নিয়ে ভয় পায়। কেউ কেউ অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চায় না। অল্প কিছু মানুষ ন্যায় বিচারের দাবীতে তার আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। অবশেষে শহরের কিছু মানবাধিকার কর্মীর সাহায্য নিয়ে মানববন্ধনটা কোনোমতে সেরে নিল। পরের দিন সবধরনের পত্রপত্রিকায় মানববন্ধনের খবর ছড়িয়ে পড়লো। পত্রিকার সংবাদে শত্রুরা ক্ষিপ্ত হলো এবং ভদ্র মহিলাকে হত্যার পরিকল্পনা করলো। আমি পরের দিন ভদ্র মহিলার বাড়িতে গেলাম এবং সংবাদ নিয়ে জানলাম তিনি বাড়িতে নাই। বাড়িতে তার এক ভাই আর দুই নাতিন আছেন। আমি জানতে চাইলাম ভদ্র মহিলা তোমাদের কে হয়? বাচ্চা দুইটি বললেন তিনি আমার নানী। আর লোকটি বললেন তিনি আমার বড় বোন। সকাল বেলায় মানবাধিকারের লোকজন মোবাইলে ফোন করেছিল। আজ সকাল ১০ টায় শহরের হত্যার প্রতিবাদে একটি মিছিল হবে। তাই তিনি সেখানে গিয়েছেন। আমি বললাম উনাকে তো আমি একটি আবেদনে গণস্বাক্ষরের কথা বলেছি আরো বলেছি এই হত্যার প্রতিবাদে আমিও তার সাথে আছি। কথা শেষ করে আমার নির্বাচনী এলাকা ঘুরে শেষে বাড়িতে এলাম। শহরের মিছিল শেষ করে ভদ্র মহিলা সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন এবং জানতে পারলেন তার বাড়িতে লোক এসেছিল খোঁজ খবর নিতে। ভদ্র মহিলাকে বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে। যেন নিঃসঙ্গ পৃথিবী তাকে ডাকছে। অনন্ত কালের বহমান চৈতন্যের এক প্রত্যাশাকে গভীর আঁধার এসে ঢেকে দিচ্ছি। বধির প্রেরণার আবেগ ধোঁয়াশায় মিশে যাচ্ছে। ঈশ্বরের বিনিদ্র চোখ গোপন সত্তার আড়াল থেকে সব দেখছে। দূর অবরোহ অদৃশ্য বিশ্বাস থেকে তার মৃত মেয়ে আর একাত্তুরের শহীদ সন্তান তাকে ডাকছে।
আকুল ভালোবাসার বেদনা আজ জীবনের মুখোমুখি। দিন যায়, রাত যায়, মাসের পর বছর যায়, আস্তে আস্তে হত্যার প্রতিবাদ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, কিছু সাক্ষীও এখন আসামীদের পক্ষে কথা বলে। দীর্ঘদিন আমিও তেমন খবর নিতে পারি নাই। মনে মনে ভাবি মানবাধিকার কর্মীরা হয়তো তার পক্ষে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। এক বিকেলে খবর পেলাম ভদ্র মহিলা খুব অসুস্থ। তার দুই নাতির জন্য লেখাপড়ার তেমন অর্থ নেই। দুবেলা কোন মতে খেতে পায়। ভাইটি বাবার পৈত্রিক বাড়িতে চলে গেছে। বৃদ্ধের সাথে এই বাড়িতে আছেন শুধু তার দুই নাতি। বৃদ্ধ মহিলার অনুপস্থিতিতে ওরা দুই জনই হয়ে পড়বে খুব অসহায়। এদিকে শত্রুরা বিচারের সব বিষয় গুলো অর্থের বিনিময়ে তাদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করছে। একদিন হেমন্তের সন্ধ্যায় ভদ্র মহিলার বাসায় গেলাম। চারিদিকে নিস্তব্ধ দূর আকাশে পরম আতর্œদীপ্তির অবলোকন সত্তা তার ক্ষুদ্রতম সত্তাকে দেখছে সিদ্ধ জ্যোতির্ময় পরিজ্ঞাত লব্ধজ্ঞানে। আমি বাড়ি গেটে শব্দ করলাম। অনেকক্ষণ শব্দ করার পর দুইটি অসহায় কিশোর কিশোরী বেড়িয়ে এলো। আমি বললাম তোমাদের নানী বাসায় নাই। বাচ্চা দুইটি অশ্রুজলভরা চোখে বললো, গত মাসে নানী মারা গেছে। নানীর ভাই ও এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আমরা এখন একা, নানী মৃত্যুর আগে বলে গেছে ওই যে উপরে রহমানের রাহিম জেগে আছেন। তিনি যদি আমাদের ভালোবাসেন তবে দেশের সব মানুষই আমাদের ভালোবাসবেন। বাচ্চা দুটি আরো বললো মায়ের হত্যার বিচারের জন্য আপনি নানীকে সাহায্য করেছেন। আলাহ যেন আপনাকে সাহায্য করে। বাচ্চা দুটির কথা শুনে আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়লো। আমার রক্তের ধমণীতে ন্যায়ের প্রতিবাদ জেগে উঠলো। আমি একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি আর আমার এলাকার হত্যাকারীদের বিচার হবে না তা হয় না। অবশ্যই আমি এই হত্যার বিচারের দাবীতে এই দুইটি শিশুর পাশে থাকবো। আমি আগামী কালই এই হত্যার জন্য সংবাদ সম্মেলন করবো। এই হত্যার প্রতিবাদে আমি সব ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করবো। এইভাবে সময় যেতে যেতে কয়েক মাস পর নতুন নির্বাচনে সরকারের ক্ষমতার বদল হয়ে গেল। কিন্তু বাচ্চা দুইটি এখনোও বিচারের আসায় তাকিয়ে আছেন। আমি বলি আমার ক্ষমতায় নেই তো কি হয়েছে নতুন সরকার অবশ্য এই হত্যার বিচার করবে। দিন যায় রাত যায় ধীরে ধীরে বাচ্চা দুইটি নিদারুণ অভাবের মধ্যে বড় হতে থাকে। দীর্ঘদিনের ক্লান্ত সময়ে বিচারের কথা মানুষ ভুলেই গেছে। ভাইবোন নানীর কবরের দিকে তাকিয়ে মায়ের বিচারের কথা মনে করে। কিন্তু দেখে সামনে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। পাশবিক প্রবৃত্তির দ্বারা তমসাচ্ছন্ন সমাজ নতুন অনুধাবনে ব্যর্থ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মহিউদ্দীন সান্তু
খুবই করুন গল্প, এরকম কত শত বিচার বাংলর বুকে বিচারের মুখ দেখেনা । সারা জীবন বিচারকের আড়ালেই থেকে যায়। লেখক চমৎকার ভাবে লিখেছেন। আনেক ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।